Brightcom Group বা BCG একসময় পেনি স্টক হিসেবে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে প্রচন্ড জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল,কারণ প্রায় ছয় মাসের মধ্যেই ১০০০% এরও বেশি রিটার্ন দিয়েছিল।
কিন্তু সেই শেয়ার আজ ফের তার অল টাইম হাই থেকে প্রায় ৯০% নিচে ট্রেড করছে, বরবাদ করেছেন বহু বিনিয়োগকারীদের। আসুন এর পিছনে থাকা প্রধান কারণগুলোকে জেনে নেওয়া যাক –
Brightcom Group কোম্পানি এর সংক্ষিপ্ত বিবরণ :
ব্রাইট কম গ্রুপ বা BCG হল হায়দ্রাবাদ বেসড একটি আইটি কোম্পানি, যা অ্যাড টেক বা ডিজিটাল মার্কেটিং এর উপর কাজ করে থাকে। প্রায় বিশ্বব্যাপী এই কোম্পানির সম্প্রসারণ রয়েছে যার টোটাল রেভিনিউর বেশিরভাগই আসে বিদেশি সহায়ক কোম্পানিগুলো থেকে। আধুনিক অ্যাডভার্টাইজমেন্ট সলিউশন ছাড়াও কোম্পানি সফটওয়্যার সার্ভিস ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি ও অন্যান্য আইটি সার্ভিস ও প্রোভাইড করে থাকে।
করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পরে ভারতীয় শেয়ার বাজারে বড় র্যালি লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে স্মলক্যাপ বা কম দামি পেনি শেয়ারগুলো বিনিয়োগকারীদের দুহাত ভরে রিটার্ন দিতে থাকে তার মধ্যে Brightcom Group ছিল অন্যতম। অল্প সময়ে বেশি রিটার্ন এর লোভে অপারেটরদের ফাঁদে পড়ে যায় শেয়ার বাজারে আসা নতুন বিনিয়োগকারীরা। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কিভাবে কোম্পানির প্রোমোটার লুটে নিল নতুন বিনিয়োগকারীদের আসুন জেনে নেয়া যাক।
Brightcom Group কোম্পানির ওপর SEBI এর ফরেন্সিক অডিট এর নির্দেশ :
SEBI সেপ্টেম্বর ২০২১ সালে এই কোম্পানিটির উপর ফরেন্সিক অডিট করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই বিষয়টি কোম্পানি এর প্রোমোটার সেই সময় বিনিয়োগকারীদের থেকে লুকিয়ে যান যা পরে ফেব্রুয়ারি ২০২২ সালে বিনিয়োগকারীদের কে জানানো হয়।
২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসেই কোম্পানি একটি প্রিফেন্সিয়াল অ্যালটমেন্ট করছিল কিন্তু ফরেন্সিক অডিট এর ব্যাপারটা বিনিয়োগকারীদের জানানো উচিত ছিল সেটা বিনিয়োগকারীদের ইনফর্ম করেনি যা নিয়ম অনুসারে অবশ্যই করা উচিত ছিল। পরে এক্সচেঞ্জ থেকেই এই বিষয়টা বিনিয়োগকারীদের জানানো হয়।
কোম্পানির প্রোমোটার দ্বারা ভুল তথ্য প্রদান:
SEBI এর পাঠানো লেটার অনুযায়ী কোম্পানির ওপরে তিন চারটি বিষয়ের উপর অডিট করার কথা বলেছে;-
- বুক অফ একাউন্টস মেনুপুলেশন
- কনসলিডেটেড ফিনান্সিয়াল স্টেটমেন্টের ভুল তথ্য প্রদান
- ইম্পেরিমেন্ট অফ অ্যাসেট
কিন্তু কোম্পানির প্রোমোটার এই সমস্ত বিষয়গুলোর উপর কোন তথ্য বিনিয়োগকারীদের দেয়নি, শুধু জানানো হয়েছে যে সেবি শুধুমাত্র ইম্পেরিমেন্ট অফ অ্যাসেট এর বিষয়ে ফরেনসিক অডিট করার নির্দেশ দিয়েছেন।
বহুবার কোম্পানির নামের পরিবর্তন :
Brightcom Group কোম্পানি পূর্বে বহুবার নাম পরিবর্তন করে। এই বিষয়ে কোম্পানি জানায় যে বিগত কুড়ি বছরে তাদের ব্যবসা সম্পূর্ণভাবে বদলে গেছে। প্রথমে এই কোম্পানির নাম ছিল Vibrant Digital তারপর Lycos নামের একটি কোম্পানিকে কিনে নেওয়ার পর কোম্পানির নাম পরিবর্তন করে নাম রাখা হয় Lycos Internet Limited এরপরেও ফের কোম্পানির নাম বদল হয় নাম রাখা হয় Brightcom Group।
বারবার কোম্পানির এই নাম বদল করা অবশ্যই একটি Red Flag এর মধ্যে পড়ে।
ফান্ড রেইস করে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ প্রদান:
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো কোম্পানি মাঝেমধ্যেই ফান্ড রেইস করতেই থাকে। একবার ভেবেই দেখুন না কোন আইটি বা টেকনোলজি কোম্পানির এতবার ফান্ড রেইস করার প্রয়োজন পড়ে ?
আইটি বা টেকনোলজি এমন এক ধরনের ব্যবসা যা ক্যাশ রিচ ব্যবসা এর মধ্যে পড়ে। TCS বিগত পাঁচ থেকে দশ বছরে একবারও ফান্ড রেইস করেনি শুধু তাই নয় টিসিএস এর শেয়ার প্রতি বছর ডিভিডেন্ড দেয় মাঝে মাঝে Buy Back ও করে।
Brightcom Group ডিভিডেন্ড তো দেয় কিন্তু সেই ডিভিডেন্ড এর ফান্ডিং আসে প্রিফেন্সিয়াল অ্যালটমেন্ট এর মাধ্যমে এর প্রমাণ হল কোম্পানির ব্যালেন্স সিট। বিগত বেশ কিছু বছর ধরেই কোম্পানির ক্যাশ ফ্লো আর ক্যাশ ফ্রম অপারেটিং অ্যাক্টিভিটিস নেগেটিভ রয়েছে। তাই কোম্পানির বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ প্রদান করার জন্য ইকুইটি ডালুয়েশন এর প্রয়োজন পড়ে।
প্রোমোটার্স হোল্ডিং কমানো ও স্টেক সেল:
প্রোমোটার্স গ্রুপের হেড বা Brightcom Group এর ফাউন্ডার মিস্টার সুরেশ কুমার রেড্ডি তার টোটাল স্টেক এর একটি বড় অংশ 2022 এর জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে ওপেন মার্কেটে সেল করে দিয়েছিল। এটা সেই সময় ছিল যখন SEBI ফরেনসিক অডিটের জন্য কঠোর নির্দেশ দেয় ঠিক সেই সময়েই Brightcom Group শেয়ার অলটাইম হাই তে ছিল।
সবথেকে বড় বিষয় হলো প্রোমোটাস তাদের শেয়ারহোল্ডিং এর প্রায় ৯০% সেল করলো কিন্তু বিনিয়োগকারীদের কখনো ইনফর্ম করেনি।
এখানে কোম্পানির প্রোমোটার একটা স্মার্ট ট্রিক খেললো কিছু পাবলিক এন্টিটিস যেখানে Brightcom Group এর চেয়ারম্যান সুরেশ কুমার রেড্ডি প্রায় 20% স্টেক হোল্ড করত সেখানে প্রায় ১০০% স্টেক কিনে পার্টনার হয়ে যায়। আর ওই পাবলিক এলএলপি গুলোকে Brightcom Group এর প্রোমোটার বানিয়ে দেয় এর ফলে প্রোমোটার হোল্ডিং প্রায় আনচেঞ্জ থাকে ঠিক এইভাবে প্রোমোটার তাদের শেয়ারহোল্ডিং সেলিং এর বিষয়টা লুকিয়ে যায়।
Brightcom Group এর বোনাস শেয়ার ইস্যু এর ফাঁদ :
একাধিকবার বোনাস শেয়ার ইস্যু করার বিষয়ে Brightcom Group কোম্পানির বিরাট বড় ইতিহাস রয়েছে। ২০২১ আর ২০২২ প্রায় এক বছরের মধ্যে দুবার কোম্পানি বোনাস শেয়ার ইস্যু করে এই লোভে পা দেয় বহু নতুন রিটেল ইনভেস্টাররা। কিন্তু মজার বিষয় হলো নিয়ম অনুসারে বোনাস শেয়ার ১৫ দিনের মধ্যে অ্যাকাউন্টে ক্রেডিট করতে হয় কিন্তু কোম্পানি বোনাস শেয়ার ক্রেডিট করতে ৮৪ দিন সময় লাগিয়ে দেয়।
সেই সময় BCG এর শেয়ার প্রায় ১০০ টাকা থেকে ৪০ টাকায় চলে আসে কিন্তু ইনভেস্টাররা তাদের শেয়ার সেল করতেও পারে না কারণ তাদের কাছে পাঁচটা শেয়ারের মধ্যে তিনটি শেয়ার ছিল। কিন্তু কোনও কোম্পানির শেয়ার যদি ৭০% নিচে যাওয়ার পর শেয়ার একাউন্টে ক্রেডিট হয় তার কোনও ভ্যালুই নেই।
Lycos অধিগ্রহণ এর সেটেলমেন্ট :
২০১০ সালে Lycos নামের একটি কোম্পানিকে Brightcom Group কিনে নেয় সেখানে ৩৬ মিলিয়ন ডলার পে করার কথা ছিল কিন্তু কোম্পানি ১৬ মিলিয়ন ডলার পে করেনি। এর ফলে নিউইয়র্ক এর কোর্টের সিদ্ধান্ত অনুসারে Brightcom Group কোম্পানি কে নির্দেশ দেয় Lycos এর মালিকানা তাদের পুরনো মালিক কে ফিরিয়ে দিতে, ২০১০ সাল থেকে শুরু করে আজ ২০২৪ সাল কিন্তু এখনো এই অধিগ্রহণের সেটেলমেন্ট হয়নি।
প্রিফেন্সিয়াল অ্যালটমেন্ট Brightcom Group এর সব থেকে বড় Scam :
ব্রাইট কম গ্রুপ এর লেটেস্ট Scam হল প্রিফেন্সিয়াল শেয়ার ইস্যু করা, কোম্পানির চেয়ারম্যান মিস্টার সুরেশ কুমার রেড্ডির প্ল্যান ছিল নিজেরই কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করে টাকা উঠানোর। কিন্তু কোম্পানির শেয়ার প্রাইস যাতে না কমে যায় তার জন্য বিগত বেশ কিছু কোয়ার্টার ধরে কোম্পানির ফাইন্যান্সিয়াল ব্যালেন্স সিটে প্রফিট বাড়িয়ে দেখানো শুরু করে। এর ফলে কোম্পানির শেয়ার প্রাইজ প্রায় ৮ টাকা থেকে 200 টাকা পর্যন্ত চলে যায়।
ঠিক এই সময় কোম্পানির চেয়ারম্যান মিস্টার সুরেশ কুমার রেড্ডি নিজে ডাইরেক্ট শেয়ার বিক্রি না করে প্রিফেন্সিয়াল অ্যালটমেন্ট এর মাধ্যমে বেশ কিছু কোম্পানিকে সস্তা দামে তাদের শেয়ার দিয়ে দেয়। ২০২০ থেকে ২০২২ পর্যন্ত কোম্পানি টোটাল ৫১ কোটি ইকুইটি শেয়ার এর প্রিফেন্সিয়াল অ্যালটমেন্ট করে থাকে যার টোটাল ট্রানজেকশন ভ্যালু ৮৬৭ কোটি টাকা কিন্তু কোম্পানি এর কাছে মাত্র ৩০০ কোটি টাকা রিসিভ হয়েছে অর্থাৎ কোম্পানির বুক অপ একাউন্টে ৫৬৭ কোটি টাকা মিসিং।
একজন ফেমাস ইনভেস্টার Shankar Sharma যাকে টোটাল ৩৭ এর প্রাইজে দেড় কোটি শেয়ার ইস্যু করা হয়। যার টোটাল ভ্যালু ৫৬ কোটি টাকা কিন্তু কোম্পানির ব্যাংকিং ট্রানজেকশনে মাত্র ৩৭ কোটি টাকা রিসিভ হয়েছে।
সম্পূর্ণ বিষয়টি ভেরিফাই করার জন্য সেবি ব্রাইট কম গ্রুপ কে ব্যাংকিং স্টেটমেন্ট সাবমিট করতে বলে সময় মতো সমস্ত ট্রানজেকশন ডিটেলস সাবমিট করেও দেয় কিন্তু সেবি যখন ব্যাংকিং ট্রানজেকশনের ভেরিফাই করে তখন জানতে পারে সমস্ত ব্যাংকিং ট্রানজেকশন এর যে ডিটেলস কোম্পানি সাবমিট করেছে পুরোটাই ফলস।
শেয়ার বাজারে পেনি স্টকে বিনিয়োগ করা অপশন ট্রেডিং এর থেকেও ঝুঁকিপূর্ণ বিশেষত নতুনরা শেয়ার বাজারে পেনি শেয়ার ইনভেস্ট করে আর কেউ কেউ অপশন ট্রেডিং করে থাকে। আপনি যদি শেয়ার বাজারে নতুন হয়ে থাকেন আর অপশন ট্রেডিং সম্বন্ধে জানতে চান তাহলে আপনি আমাদের এই কনটেন্টটি দেখতে পারেন।
শেয়ার বাজারে অপশন ট্রেডিং এর 6 টি আসল সত্য যা কেউ বলে না :
(বি.দ্র: শেয়ার বাজারে বিনিয়োগে বাজারগত ঝুঁকি রয়েছে। তাই সূচকের ওঠানামার সঙ্গে সঙ্গে বিনিয়োগ কম বা বেশি হতে পারে। স্টক মার্কেটে বিনিয়োগে লাভের কোনও গ্যারান্টি থাকে না। তাই ঝুঁকি নিয়ে নিজ দায়িত্বে বিনিয়োগ করুন।)